
বনফুল ও ঝড়ে পড়ার শব্দ
খেলা শুরুর আগেই হারিয়ে যাওয়াকে কাপুরুষত্ব বললেও জীবন শুরুর আগে জীবনের কাছে হেরে যাওয়াকে আমরা তা বলি না। কেন বলি না? এটা কি ঐ নাবালক শিশুটির প্রতি আংগুল তোলা যাবে না বলেই? নাকি যে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বোপরি যে আমাদের মাঝে শিশুটির জন্ম সেদিকে আংগুল নির্দেশ করবে বলেই? কিন্তু আপনি কি জানেন বা কখনো ভেবে দেখেছেন, কত শিশু কৈশোর পেরোনোর আগেই জীবনের খেলায় বাতিলের খাতায় নাম লেখিয়ে ফেলে? জানেন এদের অনেকের দুমোটো ভাত খেয়ে জীবন চালানোর নিশ্চয়তাও এই শৈশবেই মাটি হয়ে যায়, বিসিএস, কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়াকে এরা ভাগ্য বলে মেনে নেয়, কুটিল সমাজ এদেরকে শিখিয়ে দেয় অলৌকিক(যেমন ঈশ্বর বা কর্মের দান) কিছু বলে; এই শিশু যাদের আমরা ফুলের মত নিস্পাপ বলি তারা শিশুকালেই তো ঈশ্বরের দেওয়া এসব জীবিকার বেদিতে উঠার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে! সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা আমরা যারা মানবিক বলে দাবি করি তারা কি একটু জীবন নিয়ে খেলার সুযোগটা তাদের করে দিয়েছি! শুধু দেখুন, বাংলাদেশে যেসব আশ্রম বা গ্রামীন শিক্ষালয় আছে সেখানে ভর্তি হওয়া ৯৯ শতাংশ শিশুই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মত সম্ভাবনাকে মাটি করে সেসব প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। তাদের সুন্দর মানুষ হওয়া সেটা সুদূর পরাহত কেননা যে জীবন হার দিয়ে শুরু এবং যে জীবনে হারের চিন্হ বয়ে বেরাতে হয়, যে জীবন দুমুটো ভাতের নিশ্চয়তা দেয়না সে জীবনে মানবিকতা হল শৌখিনতা। কিন্তু আমরা তাই করে বেরিয়েছি সারাজীবন।
২০১৪ সালে আমি একটা ছোট সমীক্ষণে করে দেখেছি আশ্রম বা মক্তবে যে সব শিশু বড় হয় তাদের সকলেই জীবনের স্বপ্নবোনা বন্ধ করেই এসবে ভর্তি হয়। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হল, প্রথম দিকে ভর্তি হওয়া এসব শিশু এসএসসি পাশ হওয়ার আগেই ৬০-৭০ শতাংশ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। কিন্তু মানবতাবাদী থেকে শুরু করে ঈশ্বরের নিচে যত টাইটেল আছে সব এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালকেরা গ্রহন করে! আমাদের সমাজে আজকে হৃদয়হীনতাই যেন মানবিকতার প্রধান মাধ্যম। আহা, কত সুন্দর ফুলই না আমরা পায়ে মাড়িয়ে মানবতার সিংহাসনে আরোহন করেছি! এই ফুলগুলোর কাছে, সমাজের কাছে যে পাপ আমরা করে যাচ্ছি তার শাস্তি কি ঈশ্বরের বা কর্মের নিক্তিতে মাপা যাবে? অবশ্য সেজন্য ঈশ্বর বা কর্মের গাতানুগতিক বইয়ে এসবের উল্লেখও নেই। তাইতো হয়তো আমরা কখনো কি দেখিনি কিংবা দেখলেই অন্তরে ধারন করিনি শিশুকালেই মা-বাবার বিচ্ছেদের বিষে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিষ্ট হলে কিংবা জন্মই যদি ওর আজন্ম পাপ হত তাহলে ওর বিশ্বনেতৃত্বে আসা হত না। আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের সুবিধা নিয়ে কবি সাহিত্যিক হওয়া এসব শিশুদের ক্রেডিট যদি সমাজ বা রাষ্ট্র দাবী করে, তাহলে এসব আশ্রম, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বঞ্চিত হয়ে যেসকল শিশু হেরে গেল তাদের স্বপ্ন ভেংগে ফেলার দোষটা কেন তারা নেয় না? গৌতম বুদ্ধ বলছেন, যারা চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী করছে তাদের দায়িত্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো এড়াতে পারে না। আমরা বৌদ্ধ হিসেবে দাবী করলে এটা অনুধাবন করা উচিৎ। ব্রিজিং-জেনারেশনস সকলের কাছে সে দাবী নিয়েই এসেছে। আসুন আমাদের সামাজিক দুঃখ নিরসনে হাত বাড়াই। এসব দুঃখ সমাজকে আড়ষ্ট করার আগেই আসুন আমরা এগুলোকে জয় করি। যে ফুলগুলোকে পিষ্ট করেই মানবতার সিংহাসনে আমারা বসছি, সে সুন্দর ফুলগুলোকে বেদিতে সাজিয়ে রেখে, কিংবা মাথায় খোপা করে সাজিয়ে রাখলে সমাজ, জাতিকে সমৃদ্ধ দেখাবে। আপনি তখনই জয়ের হাসি হাসবেন।
গৌতম বুদ্ধ দুঃখ নিপীড়িতদের দেখে মুচকি হাসতেন কারন সেসব দুঃখ তাকে অনুরিত করলেও, আড়ষ্ট করে নাই; তার দুঃখের বিনাশ এসছে এভাবেই। আমাদের সামাজিক দুঃখগুলো আমাদের আড়ষ্ট করে রেখেছে, অনুরনন তৈরী করে নাই। দুঃখমুক্তি হবে কিভাবে? দুঃখকে দেখে আলিংগন করুন, অনুধাবন করুন হাসিমুখেই আপনি দুঃখকে মোকাবেলা করতে পারবেন। যদি, ভয়ে দূরে সরে যান দুঃখ আপনাকে কখনো পিছু ছাড়বে না। আসুন, আমাদের গরীর মেধাবী সন্তানদের কোলে তুলে নিয়ে সুন্দর বেদিতে বসাই। আমাদের সমাজ সুন্দর দেখাবে, জাতি সমৃদ্ধ হবে। সামাজিক পরিবেশ পুষ্ট হবে। কেননা, বস্তিতে শীততাপনিয়ন্ত্রিত পাকা রাজপ্রাসাদ করার মহত্ততা থেকে গুলশানের ভিয়াইপি জায়গায় একটি ছোট ঘড় করার কৃতিত্বই আলাদা।
read more